বিশেষ প্রতিনিধি, বিশেষ প্রতিনিধি।।
দক্ষিণ ডাকোটায় বাইরের জগৎ থেকে সুরক্ষিত এই বিশাল গুহায় স্থাপন করা হবে সংবেদনশীল যন্ত্রপাতি, যেগুলোর মাধ্যমে পরমাণুর চেয়েও ক্ষুদ্র কণার সামান্যতম পরিবর্তন শনাক্ত করা যাবে | ছবি- সার্ফ
বিজ্ঞানীরা দেখতে চান—নিউট্রিনো ও অ্যান্টি-নিউট্রিনোর এই রূপান্তর একইভাবে ঘটে কিনা। যদি না ঘটে, তাহলেই হয়তো ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে কেন অ্যান্টিম্যাটার ধ্বংস হয়ে ম্যাটার টিকে গেছে—অর্থাৎ, কেন আমরা আছি।
আমরা কেন আছি? মহাবিশ্ব কেন ধ্বংস হয়নি জন্মলগ্নেই? কেন আলো আছে, ছায়া আছে, গ্রহ-নক্ষত্র-গ্যালাক্সি আছে—আর সবচেয়ে বড় কথা, আমরা মানুষ কেন এই মহাবিশ্বে বেঁচে আছি? এই চিরন্তন ও মৌলিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই এখন বিশ্বজুড়ে চলছে প্রতিযোগিতা। বিশ্বের দুই প্রান্তে, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানে শত শত বিজ্ঞানী কাজ করছেন এক সুক্ষ্ম ও রহস্যময় কণাকে ঘিরে—নিউট্রিনো।
দক্ষিণ ডাকোটার গভীর জঙ্গলের নিচে, মেঘে ঢাকা পাহাড়ের কোলে এক গোপন গবেষণাগার স্যানফোর্ড আন্ডারগ্রাউন্ড রিসার্চ ফ্যাসিলিটিতে (সার্ফ) নির্মাণ হচ্ছে বৈজ্ঞানিক ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ প্রকল্প—ডিউন (ডিপ আউন্ডারগ্রাউন্ড নিউট্রিনো এক্সপেরিমেন্ট)। ১,৫০০ মিটার (প্রায় ৫,০০০ ফুট) মাটির নিচে খনন করা হয়েছে তিনটি বিশাল গুহা, যেখানে বিজ্ঞানীরা নিউট্রিনো কণার আচরণ পর্যবেক্ষণ করবেন। প্রকল্পটির নির্মাণকাজে যুক্ত ছিলেন ড. জ্যারেট হেইজ, যিনি এই গুহাগুলিকে ‘বিজ্ঞানের গির্জা’ নামে অভিহিত করেছেন।
এই গভীর স্থানে গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তোলার কারণ হলো পৃথিবীর ওপরের তেজস্ক্রিয়তা, শব্দ, এবং নানাবিধ ব্যাঘাত থেকে রক্ষা পাওয়া। নিচের এই নিস্তব্ধ পরিসরে নিউট্রিনোর ক্ষীণ সংকেত ধরা সম্ভব হবে। ড. হেইজ বলেন, ‘আমরা এখন প্রস্তুত। ডিটেক্টর বানানো শুরু হচ্ছে, যার মাধ্যমে হয়তো আমরা জানতে পারব—কেন আমরা এই মহাবিশ্বে আছি।‘
বিজ্ঞানীরা জানেন, বিগ ব্যাংয়ের সময় তৈরি হয়েছিল ম্যাটার ও তার ঠিক বিপরীত অ্যান্টিম্যাটার। একে অন্যের পরিপূরক এই দুই কণার সংঘর্ষে সবকিছুই ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কথা। তাহলে কীভাবে টিকে গেল পদার্থ? কীভাবে গঠিত হলো গ্রহ-নক্ষত্র? আর আমরা? এই রহস্যের উত্তর পেতেই বিজ্ঞানীরা তাকিয়েছেন নিউট্রিনো নামের এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণার দিকে। এটি প্রায় কিছুতেই প্রতিক্রিয়া দেখায় না। সেকেন্ডে ট্রিলিয়ন নিউট্রিনো শরীরের ভেতর দিয়ে চলে গেলেও আমরা টের পাই না। কিন্তু বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে অস্তিত্বের সূত্র।
যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা নিউট্রিনো ও এর বিপরীত কণা অ্যান্টি-নিউট্রিনো তৈরি করে পাঠাবেন ইলিনয়ের ফারমিল্যাব থেকে ৮০০ মাইল দূরের দক্ষিণ ডাকোটার ডিউন ডিটেক্টরে। এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে কণাগুলো নানা রূপে পরিবর্তিত হয়। বিজ্ঞানীরা দেখতে চান—নিউট্রিনো ও অ্যান্টি-নিউট্রিনোর এই রূপান্তর একইভাবে ঘটে কিনা। যদি না ঘটে, তাহলেই হয়তো ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে কেন অ্যান্টিম্যাটার ধ্বংস হয়ে ম্যাটার টিকে গেছে—অর্থাৎ, কেন আমরা আছি।
একই উদ্দেশ্যে জাপানের বিজ্ঞানীরা তৈরি করছেন হাইপার-কে নামের ডিটেক্টর। এটি আগের সুপরিচিত ডিটেক্টর সুপার-কে’এর উন্নত ও বৃহৎ সংস্করণ। জাপানি গবেষণা দলটির আশা, আগে শুরু করে বড় আকারের ডিটেক্টরের মাধ্যমে তারা দ্রুত ও স্পষ্ট ফলাফল পাবে। ইমপেরিয়াল কলেজ লন্ডনের গবেষক ড. মার্ক স্কট বলেন, ‘আমরা দ্রুত শুরু করছি, ডিটেক্টরও বড়। তাই আমাদের সেন্সিটিভিটিও বেশি হবে। আমরা প্রথমেই হয়তো একটা বড় আবিষ্কার করে ফেলতে পারি।‘
তবে ডিউন প্রকল্পে যুক্ত ড. লিন্ডা ক্রেমনেসি মনে করেন, হাইপার-কে এখনো পূর্ণাঙ্গ গবেষণার জন্য প্রস্তুত নয়। তার ভাষায়— হাইপার-কের সব উপাদান এখনো নেই। যা দিয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে নিউট্রিনো ও অ্যান্টি-নিউট্রিনোর আচরণে পার্থক্য আছে কিনা।
এই প্রতিযোগিতা এক অর্থে উদ্দীপনামূলক হলেও বিজ্ঞানীরা একমত—উভয় গবেষণা একসঙ্গে চললে তথ্য ও ফলাফল আরো সমৃদ্ধ হবে।